ঢিমেতালে নজরদারি, কুরিয়ারে বহন হচ্ছে মাদক

এম.জমিন •

কৌশলী মাদক ব্যবসায়ীরা এখন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক বহন করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতেই এমন কৌশল অবলম্বন করছে তারা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ঢিমেতালে নজরদারির সুযোগই তারা কাজে লাগাচ্ছে।

এতে করে বিভিন্ন পণ্যর আড়ালে খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে মাদকদ্রব্য। শুধু দেশের ভেতরে কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক বহন হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে অনেকে বিদেশ থেকে নতুন কিসিমের মাদক দেশে আনছেন।

সম্প্রতি এলএসডি ও ডিএমটি নামক দুটি ভয়ঙ্কর মাদক উদ্ধার ও বহনকারীদের আটকের পর গোয়েন্দারা বিদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক আনার তথ্য জানতে পেরেছেন। গত মে মাসে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের মিরপুর শাখায় ফলের কার্টুনের ভেতর থেকে ২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক এক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমেরিকার ব্রকলিন সিটিতে ইয়াবা পাঠানোর সময় সেই চালান জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪টি চালানে ২১ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর সময় উদ্ধার করা হয়।

কুরিয়ার সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৭০০ কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করছে। এরমধ্যে ১৪০টি প্রতিষ্ঠান এসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত। আর মাত্র ৭০টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সধারী। লাইসেন্সের বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তারাই মূলত অবৈধ পণ্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আনা নেয়া করে বাড়তি টাকা আয় করছে। লাইসেন্সধারী অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলেছেন, তাদের জানা মতে এ ধরনের কাজ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তবে অসাধু বুকিং অফিসারদের কেউ কেউ হয়তো টাকার বিনিময়ে এরকম কাজ করতে পারে। কুরিয়ার সার্ভিসের সব পণ্য যাচাই-বাছাই করার মতো সুযোগও তাদের কাছে নেই বলে তারা জানিয়েছেন। কারণ পণ্যগুলো প্যাকেট করেন গ্রাহক নিজেরাই। একাধিক কার্টন হলে সেগুলো পরীক্ষা করা কঠিন। এছাড়া সব কুরিয়ার সার্ভিসের পক্ষে ডিটেকটর মেশিন কেনাও সম্ভব নয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিদিন অহরহ পণ্য সারা দেশে যাওয়া আসা করছে। সব প্রতিষ্ঠানের সবকিছু নজরদারি করা সম্ভব হয় না। তবুও গোয়েন্দা তথ্যর ভিত্তিতে সম্প্রতি নজরদারি বাড়িয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক চালান জব্দ করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক কুসুম দেওয়ান বলেন, বিমানবন্দরগুলোতে মাদক শনাক্তের মেশিন না থাকায় কারণে অনেক নতুন কিসিমের মাদক যাত্রীরা বহন করতে পারছে। তাই বিমানবন্দনগুলোতে আধুনিক ডিটেকটর বসানোসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করতে হবে। কিছু আন্তর্জাতিক ও দেশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অনেকে মাদক আনছে। এসব কুরিয়ার সার্ভিসকে নজরদারি করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি চালানও ধরা হয়েছে।

করোনাকালে বেড়েছে চাহিদা: এদিকে অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনাকালে মাদকদ্রব্যর চাহিদা অনেকটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ে কাজ করেন এমন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা।

তারা জানিয়েছেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একশ্রেণির যুবক-তরুণরা মাদকের প্রতি ঝুঁকছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে। পড়ালেখার কম চাপ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। এছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষও বিভিন্ন রকম হতাশায় পড়ে মাদক সেবন করছেন।

দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ওই মাস থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে টানা ছুটি কাটাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া এপ্রিল মাস থেকে লকডাউন শুরু হওয়াতে চাকরিচ্যুত হয়েছেন অনেকে। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। এতে করে অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। মানসিক চাপ কমাতে তারা মাদক সেবন করছেন। এসব কারণে গত বছর করোনার মধ্যে দিয়েও দেশে মাদকের চাহিদা তুঙ্গে ছিল।

সেবনকারীদের চাহিদা থাকায় ব্যবসায়ীরা নানা উপায়ে মাদক সরবরাহ করেছেন। তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মাদকের চালান জব্দ করেছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে বেশি মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র?্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩১৭ পিস ইয়াবা, ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৭ বোতল ফেনসিডিল, ৫০ হাজার ৭৮ কেজি গাঁজা, প্রায় ৭২ কেজি আফিম এবং প্রায় ৪ কেজি কোকেন উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় হওয়া ৮৫ হাজার ৭১৮টি মামলায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ এর আগের বছর দেশে করোনা সংক্রমণের কোনো প্রকোপ ছিল না। কিন্তু তুলনামূলক কম মাদক উদ্ধার হয়েছে।

২০১৯ সালে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৩২৮টি ইয়াবা বড়ি, ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৬৩ বোতল ফেনসিডিল, ৫০ হাজার ৭৮ কেজি গাঁজা, ৩২৩ কেজি হেরোইন, ১ কেজি আফিম ও ১ কেজি কোকেন উদ্ধার করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসেই সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৭৯৫টি ইয়াবা বড়ি, ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৭৭ বোতল ফেনসিডিল, ২৪ হাজার ৮৬৮ কেজি গাঁজা, ১২৯ কেজি হেরোইন, ৫৩ কেজি আফিম ও আধা কেজি কোকেন উদ্ধার করে। এসব ঘটনায় হওয়া ৩০ হাজার ৫৮৮টি মামলায় ৩৯ হাজার ৭৭৪ জনকে আসামি করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র জানায়, করোনাকাল ২০২০ সালে রাজধানীতে ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪৯টি ইয়াবা বড়ি, ৭৭ হাজার ৮৩৩ বোতল ফেনসিডিল, ৪ হাজার ৬৮১ কেজি গাঁজা, ৫৭ কেজি হেরোইন, ৩ কেজি কোকেন ও ৩ কেজি আফিম উদ্ধার করে ডিএমপি। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ১৮ হাজার ৫৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ২৭৪টি ইয়াবা বড়ি, ৬৮ হাজার ৩২৫ বোতল ফেনসিডিল, ৩ হাজার ৪৪৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ডিএমপি ২৫ হাজার ৮৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আগের বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মাদকের চেয়ে চলতি বছরের এই সময়ে মাদক উদ্ধার বেশি হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৬৪৪টি ইয়াবা, ৩৫ হাজার ২০৯ বোতল ফেনসিডিল, ৩ হাজার ৭৪৪ কেজি গাঁজা, ৩৩ কেজি হেরোইন, ১০ কেজি আফিম ও ৩ কেজি কোকেন উদ্ধার করে ডিএমপি। গত বছরের এই পাঁচ মাসে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৫টি ইয়াবা, ২১ হাজার ৮২৫ বোতল ফেনসিডিল, ১ হাজার ৫৯ কেজি গাঁজা, ১৯ কেজি হেরোইন উদ্ধার করেছে ডিএমপি।